Trouble with Bangla Script viewing ?!

Bangla Font problem? click here to get unicode font support. http://www.omicronlab.com/avro-keyboard.html

aamra animation

Friday 20 September 2013

Cross Border Killing of Felani and Impunity : Our Approach / ফেলানী হত্যা এবং বি.এস.এফ.-র নিঃশাস্তি : এখন সময় প্রতিবাদের

স্থান - কুড়িগ্রাম, অনন্তপুর ফুলবাড়ি সীমান্ত, আরও নিখুঁতভাবে বললে, ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত নং-৯৪৭, ৩ ও ৪ নং পোষ্ট। উপমহাদেশের সীমান্ত প্রহরার ইতিহাসে, ইতোপূর্বে যতগুলি অমানবিক ঘটনা ঘটেছে তার সবকটিকে বোধহয় ছাপিয়ে গেছে ৭ই জানুয়ারি, ২০১১-র ঘটনা। আর এই নিষ্ঠুরতার নির্লজ্জ রূপকার, ভারত রাষ্ট্রের সীমান্ত-রক্ষী বাহিনীর ১৮১ নং ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্প, এক কথায় বি.এস.এফ.।

এই ভূখণ্ডে ধর্মরাজনীতি আর পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের আঘাতে জর্জরিত অসহায় মানুষ শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে পাড়ি দিতে বাধ্য হয় দুর থেকে দুর্গমে অহরহ। এই যাত্রাপথে কিছু সফল হয়, কিছু নিষ্ফল হয়ে ফিরে এসে দিন গুনতে থাকে মৃত্যুর, কিছু মানুষ পথেই ঝরে যায়। এই পটভূমিতে বছর দশ আগে বাংলাদেশ থেকে একটি পরিবার উপার্জনের তাগিদে এসেছিল ভারতের মাটিতে।

নুরুল ইসলাম নুরু। বাপের ইন্তেকালের পর বিধবা মা আর ভাইকে নিয়ে এসে ওঠে জলপাইগুড়িতে। কয়েক বছর এদিক ওদিক ঠোক্কর খেতে খেতে এক সময় থিতু হয় আসামের বঙ্গাইগাঁওতে, কি করে যেন একটা মুদির দোকানও করে ফেলে। কালে কালে মাতৃবিয়োগ হয়, জাহানারা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় নুরুর, জন্মানোর কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় প্রথম দুই কন্যা সন্তানের। তৃতীয় সন্তানেরও একই গতি হবে ভেবে বাপ-মায় নাম রাখে ফেলানী। অভাবী মুসলিম সংসারের এ ছবি মোটেও নতুন কিছু নয়।

মুদির দোকান চালিয়ে এটা ওটা করে কিছুতেই কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সংসার চালাতে নুরু তাই কাজ খুঁজে চলে যায় দিল্লীতে। ফেলানীও যায় তার সাথে। পরিচারিকার কাজ খুঁজে নেয় ফেলানীও। এখন সে ১৫। বাপের কষ্টের খানিকটা লাঘব করতে হবে তো। তাছাড়া তার বিয়ের খরচ যোগাড় করাটাও তো দরকার, একা বাপ আর কতটা টানবে। কানাঘুষোয় ফেলানী শুনেছে তার বিয়ের কথা হয়ে রয়েছে, ১০ বছর আগেই বাংলাদেশের চরকুলাঘাটের আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। গতবছর ফাল্গুন মাস থেকেই বিয়ের দিন ঠিক হয়ে রয়েছে এই জানুয়ারির ৯ তারিখে। মানে বাকি আর মাত্র তিনটে দিন। বাপ মেয়ে বাড়ি ফেরে ট্রেনে চড়ে।

৬ই জানুয়ারি, ২০১১। কিশোরীর মন-কোনে কিসের যেন রিনরিনে খুশির আবেশ। এখন বোধহয় ফুল ছড়ানোর পালা / রাই যে বসে গাঁথছে মালা আসবে বলে কালা...। মা ফেলানীকে হাতে, পায়ে, কানে, নাকে, গলায়, সোনা-রুপোর গয়না গড়ে দিয়েছে। ৯০০ টাকা দিয়েছে হাতখরচের জন্য। ফেলানী নিজেও লুকিয়ে একটা রুমাল আর কিছু উপহার কিনেছে হবু জীবনসঙ্গীর জন্য। বাবা নুরুল ইসলামের সঙ্গে মেয়ে আজ আসাম থেকে রওনা হচ্ছে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।

চৌধুরীহাট, খেতাবকুঠি এলাকায় পৌঁছতে পৌঁছতেই রাত হয়ে গেল। যদিও দালালের সাথে দর কষাকষি পর্ব ঠিকঠাক ভাবেই চুকেছে, তবুও কাঁটাতার পেরোনোর সময়ের ভয়টা বাবা নুরুল ইসলামের পিছু ছাড়ছিল না। সকাল থেকে উত্তেজনায় মায়ের দেওয়া নতুন গয়নাগুলোর ওপর ভারী লাল সোয়েটারটা পরে বাপের সাথে মেয়েকেও এবাড়ি থেকে ওবাড়ি টানা হ্যাঁচড়া হতে হয়েছে সমানে। শীতের রাতে অবসাদে খুব ঘুম পাচ্ছিলো ফেলানীর, কিন্তু উপায় তো নেই...। কেন যে এত দেরী করছে এরা...।

জেগে জেগেই রাত শেষ হয়ে এলো। শীতকালের ভোর, এখনো আলো ফুটতে দেরী আছে, ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে চরাচর। এটাই মোক্ষম সময়। দালালরা আলগোছে তিনটি বাঁশের মই লাগিয়ে দেয় ত্রিস্তরীয় কাঁটাতারের বেড়ার ৩ আর ৪ নম্বর পোষ্টের মাঝখানে। এবার শুধু মই বেয়ে এপার থেকে উঠে ওপারে নামা। উত্তেজনা কাঁটা দেয় কিশোরীর গায়ে।

সময় ৬টা ১৫মি.। মইটা ঠিক আছে কিনা দেখা দরকার তাই বাপ নুরুই প্রথমে উঠে পড়ে মই বেয়ে, নেমেও যায় ওপারে। উফ্‌... একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস। এবার মেয়ের পালা। কাঁপা কাঁপা হাতে মই বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে পড়ে কিশোরী কনে। মইটা ভীষণ কাঁপছে, সাথে কাঁপছে ত্রিস্তরীয় কাঁটাতারের বেড়াটাও। মাঝখানে পৌঁছে এবার পিছন ফিরে ওপারের মইটায় পা বাড়ায় সে। এক ধাপ নেমেছে কি নামেনি, মনে হল আচমকা কে যেন তাকে টেনে ধরেছে। মুহূর্তে, চেতনায় আকস্মিক ভয়ের এক প্রচণ্ড ঘা। ভয়ার্ত কণ্ঠে মেয়েটা জোরে ডেকে ফেলে বাবাকে। ফল হয় মারাত্মক। নিমেষে আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট। কাঁটাতারের কামড় থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় ফেলানীও। যতই ছাড়াতে চায় আরো জড়িয়ে যেতে থাকে হাত, পা। বার্বওয়্যারের ছনছনে ধাতব আওয়াজ আর পোষ্টের নড়াচড়া লক্ষ্য করে মূর্তিমান যমদূতের মত হাজির হয়ে যায় ১৮১ নং ব্যাটালিয়ন, চৌধুরীহাট ক্যাম্পের সশস্ত্র প্রহরীও। সময় ব্যায় করে না ভারতরাষ্ট্রের কর্তব্যপরায়ণ জওয়ান, ট্রিগার টিপে দেয়। একটু স্ফুলিঙ্গ, একটু বারুদের গন্ধ, একটা বিকট আওয়াজ...। একটি মাত্র বুলেট, ভয়ার্ত কিশোরীর বুকের ডানদিক থেকে ঢুকে পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে যায় নির্দ্বিধায়।

কিছুক্ষণ সব স্থির, চুপচাপ। তরলের নিজস্ব ধর্মে, উষ্ণ শোণিত, গড়িয়ে আসতে থাকে বাধাহীন ভাবে। ঝুলতে থাকা অসাড় ডান হাতের সোয়েটার ভিজিয়ে আঙ্গুল ছুঁয়ে মাটি স্পর্শ করে ফোঁটা ফোঁটা লাল। বুলেটের আঘাত আর কাঁটাতারের সঙ্গে অসম লড়াইতে হেরে গিয়ে সীমান্তের মাঝখানে কিশোরী শরীরটা এলিয়ে যেতে থাকে। তবু লড়াই তার থামেনা। ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে আসে, পানি... পানি... একটু পানি...। একটু জল চায় সে। সে স্বর কর্তব্যরত(?) উর্দি-ধারী জওয়ানের কানে পৌঁছলেও, পৌঁছয়-না হৃদয়ে। কাতর প্রার্থনা চলে আধঘণ্টা। প্রশ্বাসে বারুদের গন্ধ, আচ্ছন্ন চেতনা, গলা শুকিয়ে কাঠ। তার পর আর সে পারেনি...। ফেলানি আর পারেনি। কাটা ঘুড়ির মত ঝুলতে থাকে আকাশ আর মাটির মাঝখানে ‌‌‌‌‌‌‌‌বছর ১৫'। শুধু মায়ের পরানো হারটা, হবু প্রণয়ীকে কিশোরী মনের, গোপন অভিমানের কথা জানান দিতে দুলতে থাকে, দুলতেই থাকে...।

বি.এস.এফ.-র অমানবিকতার নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন হয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা ঝুলতে থাকে ফেলানীর শরীরটা। বাঁচার তাগিদে শেষ প্রশ্বাস পর্যন্ত তার, হাত বাড়িয়ে মাটি ছোঁয়ার আপ্রাণ চেষ্টার স্থির চিত্র পৃথিবী দেখেছে, আমলারা দেখেছে, ভারতরাষ্ট্র দেখেছে, সারা বিশ্ব দেখেছে। কিন্তু আর্মি বিচারালয় দেখেনি। দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে তদন্ত চলা কালীন অভিযুক্ত জওয়ান অমিয় ঘোষ তার অপরাধ স্বীকার করলেও বি.এস.এফ.-র নিজস্ব বিশেষ বিচারালয় এই মর্মান্তিক ঘটনায় বি.এস.এফ-এর কোনো অপরাধই দেখতে পায়নি...। ঠিক যেমন রায় বেরোনোর পরে পুনর্বিচারের উদ্দেশ্যে ভারত থেকে সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মীদের ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলামের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন নামঞ্জুর করায়, বাংলাদেশ হাই-কমিশন কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পায়নি। ভিসা দেওয়ার নামে প্রায় ছয়দিন ধরে কলকাতা-স্থিত হাইকমিশনের তরফে তাদের হয়রানি করা হয়েছে। এমনকি কি কারণে ভিসা মঞ্জুর করা হয়নি তারও কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ হাই-কমিশন থেকে জানানো হয়নি।

‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌আমরা ভারতবর্ষ'- হাজার খুঁত থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এই ভূখণ্ডে আমাদের গর্ব করার মত একটি গণতান্ত্রিক পরিসর আছে। বুক ফুলিয়ে বলা যায়, এ মাটি রাষ্ট্রের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছুপা হয় না। তা সে কাশ্মীর হোক বা উত্তর-পূর্ব ভারত, পস্কো হোক বা নন্দীগ্রাম। একই ভাবে আমরা ভারতরাষ্ট্রের ফেলানী হত্যার বিচারের নামে এই প্রহসনকে তীব্র ধিক্কার জানানো উচিত বলে মনে করি। এও মনে করি ‌‌‌‌‌‌‌‌এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে' ফেলানীর পরিবার সুবিচার না পেলে তা আমাদের গণতন্ত্রের গৌরবকে কালিমালিপ্ত করবে। এবং তা করবে ভারত রাষ্ট্র। দুই দেশের সাধারণ মানুষ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। ধর্ম-রাজনীতির কারবারীরা চায় একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখুক, শত্রু ভাবুক। ফেলানী হত্যা এবং হত্যার সুবিচার না হওয়া সেই শক্তিগুলির হাত শক্ত করবে। ভারত রাষ্ট্রের এই হঠকারিতার প্রেক্ষিতে আমরা তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।

আমরা তাই ফেলানীর পরিবারের প্রতি সুবিচারের বিষয়ে আপনাদের মতামত জানতে আগ্রহী। রাজনৈতিক দল-চিহ্নমুক্ত পরিসরে, ছাত্রছাত্রী, ব্যক্তি মানুষ, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাগরিক সমাজের সর্বস্তরের মানুষদের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা করে কোনো কর্মসূচি নেওয়া যায় কি না, গেলে কবে, কোথায় তা করা যায় সে বিষয়ে মতামত জানতে পারলে উদ্যোগ গ্রহণে সুবিধা হবে বলে মনে করি...।

ধন্যবাদের সঙ্গে
আমরা-এক সচেতন প্রয়াস