Trouble with Bangla Script viewing ?!

Bangla Font problem? click here to get unicode font support. http://www.omicronlab.com/avro-keyboard.html

aamra animation

Thursday 9 November 2017

LALON FAIR, 2017 AND AAMRA

লালন মেলা, ২০১৭ এবং আমরা-
অমিতাভ সেনগুপ্ত
প্রতি বছর ১লা কার্ত্তিক লালনের তিরোধান দিবসে লালন মেলা হয় বাংলাদেশের কুষ্টিয়া সদরের কুমারখালি থানার ছেউঁরিয়া গ্রাম( এখন আর গ্রাম বলি কি করে!)।এই বছর ইংরেজি হিসেবে ১৬ থেকে ১৮ নভেম্বর পড়েছিল ১লা কার্তিক ঘিরে লালন সাঁই এর তিরোধান এর তিথি। এবার ১২৭ তম তিরোধান দিবস উৎসব।
"আমরা, এক সচেতন প্রয়াস" বা সংক্ষেপে ‘আমরা’ (AAMRA- An Assemblage of Movement Research and Appraisal, Kolkata), 'কৌম সংঘাত' নিয়ে কাজ করি ঠিকই, কিন্তু সংঘর্ষ পেরিয়ে নির্মাণও আমাদের কাজের পরিধির মধ্যে পরে। 'এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে, যেদিন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ ক্রিস্টান...'(যদিও মতান্তরে এটি লালনগীতি নয়) - এই অনুভবে মেলার মাঠে জাত, ধম্ম এক পাশে থুয়ে সবাই যেমন মেশে, আমরাও গিয়ে মিলি। আশরাফ আতরাফ হিন্দু মুসলমান সবাই।
যাবার দিন কয় আগে ফোন করেছিল পুনা থেকে আমাদের এক গান পাগল, মিউজিসিয়ান বন্ধু কেশব আয়াঙ্গার, সুরের টানে ও ছুটে বেড়ায় নানা জায়গায়। লালন সাঁই এর গানে সন্ত কবীর বা তুকারাম এর ভাবনার উপস্থিতির সাথে পরিচিত হতে গিয়েই টান টের পেয়েছিল, তাই কুষ্টিয়া যাবো শুনে তড়িঘড়ি কলকাতায় এসে সঙ্গী হলো।এপারে গেদে ওপারে দর্শনা হয়ে যাত্রা পথটুকু ও মজাও পেলো আর শুনে দেখে প্রশ্ন শুধিয়ে নিজের মতো বুঝতে চাইলো এই বাংলা ভাগ কতোটা ‘আপন ঠকানো’। ২০১৫ সালে ‘আমরা’র তরফে শুভপ্রতিমদা (শুভপ্রতিম রায় চৌধুরী), ইন্দুভূষণদা (ইন্দুভূষণ মন্ডল), আর নাসিমা খাতুন এসেছিলেন। এবার আমরা দুজনে। কেশব একটি পুরো বাক্যও বাংলা লিখতে পড়তে কইতে না জানলেও গানের ভাষা যে সার্বজনীন তা বাউল শুনে কেশবের বুঁদ হয়ে থাকা দেখেই বোঝা যায়। 'বুঝেছি' ভাবে ঘাড় নেড়েই বাকি কটা দিন কত লোকের 'দোস্তো' হলো! নতুন একখানা কাঁঠাল কাঠের দোতারা হলো, ওস্তাদ কারিগর-শিল্পী বিশু ভাইয়ের কাছে ওর তালিম হলো, 'আবার আসবেন ভাইয়া' আমন্ত্রণ রইলো, 'কবে ঘুরে আসবেন' তার প্ৰতিশ্রুতিবদ্ধ হলো...'ভাব'-এর ভাবে, আটকালো না ভাষায়!
মেলায় পা দিয়ে শুরুতে কিন্তু ও একটু আশাহত হয়েছিলো...ওই 'হট্টমেলা'য়, বাউল নিয়ে, মেলা নিয়ে তার মনের মানসপ্রতিমা ভাঙার দায় আমার কাঁধে নেওয়া উচিৎ, কেননা নিৰ্জন একান্তের ফকির কুটীরের ছবি আমার মুখে শুনে শুনেই ও মনে এঁকে ফেলেছিলো খানিকটা।
যে কোনো কিছু নিয়েই 'কি ছিনু- কি হনু' আফসোস তো আমাদের সাংস্কৃতিক 'ঐতিহ্য'(!), এড়াতে চেয়ে লাভ নেই, ওই রাস্তায় হেঁটেই বলি,
বহু মতভেদ-এ১৮৭০-এর ১৭ অক্টোবর বা বারোশ সাতানোব্বুই-এর পয়লা কার্তিক, পাখি অচিন, ছেড়ে যায় খাঁচা। মাধব চন্দ্র কর ও পদ্মাবতীর পুত্র হিঁদু কায়স্থ ঘরের সন্তান , বা সিরাজ শিষ্য ফকির লালন সাঁই-এর ("ব্রাত্য লোকায়ত লালন"- সুধীর চক্রবর্তী)এন্তেকাল এর তারিখে পয়লা কার্তিক বসে মেলা। তাঁর নামে ছাপা হয়েছে সরকারি ডাকটিকিট। মেলা জুড়ে জ্যোতি ঠাকুর-এর আঁকা প্রতিকৃতি ছেপে টিশার্ট; বা কফি মগে হরেক রকমের লালন; একতারা খমকের সারি দেওয়া দোকান; সরকারী ‘মূল মঞ্চে’ ‘নির্বাচিত’ (?) বাউল ফকিরদের তেরাত্তির গান; "শরীয়ত বিনা মারেফত কানা , বেহেস্তের পথ নির্দেশ" পুস্তকাদির পসরা- সে এক এলাহি কাণ্ড। আরো আছে মুঠো ফোনের মেমরি চিপে ‘লালন গীতি লোড দেওয়া হয়’ দোকানে ছেলেপান-এর ভিড়।ছোট বড় মেজ যতেক রকমের সরকারি দল ও আমলার সমাবেশ। লালন যেখানে বাণিজ্য, ক্ষমতা জাহিরের সাম্রাজ্য।
১৯৬৩ সালে পাকিস্তান আমলে ‘লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র’-এর পত্তন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮-এ হয় ‘লালন একাডেমী’। স্থান মাহাত্যে "tangible cultural heritage in need of safeguard' বলে UNESCO ২০০৪থেকে ২০১০ পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমিকে অনুদান দিতে থাকে। ফকির দের একাংশের 'সাঁইজীকে কংক্রিটের বাহুল্যে ঘেরার' তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ২০০৪-এ বিএন পি সরকার মাজার চত্বরে বানায় একাডেমির পাকা বাড়ি।অন্যদিকে ‘লালন মাজার ও সেবাসদন রক্ষা কমিটি’ মন্টু শা ফকিরের নেতৃত্বে মামলা করে যে এই লালন আখড়া ও মাজারে ফকিররাই ‘ব্রাত্য’,এর বিচার চাই। ২০১১য় দুর্নীতির অভিযোগে নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আবার সরকারি হাতে দায়িত্ব ফিরিয়ে নেয়...কালী নদী আজ মরা খাত। রাত কত হলো,উত্তর মেলেনা।
মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে লাখো লাখো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের মত এদের দশা, কেউ নিতে চায়না। এসব কথা আমরা বসে শুনছিলাম কিন্তু চট্টগ্রাম বা চিটাগাং-এ নয়, কথা হচ্ছিলো কুষ্টিয়ায় বসেই.বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ফকিরদের মাঝে বসেই, কথা হচ্ছিলো।
বাংলাদেশে বাউল ফকিরদের ওপর শরীয়তপন্থীদের আক্রমণ চলছে বহু বছর ধরে। কুষ্টিয়ার বর্ষীয়ান মরমী মানুষ লালিম হক সাহেবের বাসায় তাদের বহু বছরের কৃষ্টি চর্চার ঘর ‘ভাবের ঘর’-এ বসে। গতবারের সফরে ‘আমরা’ ডেরা বেঁধেছিল এখানেই। বনস্পতির ছায়াতলে পেলাম অনেক অরূপ রতন।কথা হলো কুষ্টিয়া কলেজের অধ্যাপক 'লালন স্মরণোৎসব কমিটি'র পদাসীন ড. মাসুদুর রহমানএর সঙ্গেও। সঙ্গে থাকছিলেন আরিফিন পাপ্পু, আমাদের ইন্দুভূষণ'দার সঙ্গে গোটা ভারতবর্ষ ব্যাপী কবীর চর্চার বিস্তার নিয়ে একটি ভিন্ন মাত্রার তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজে যুক্ত পাপ্পু ভাই। দুই বাংলায়-ই অনেক মনে রাখার মতো সময় কেটেছে তার সাথে 'আমরা'র বন্ধুদের, তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আরিফিন ভাই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে আলাপ করালেন বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধা ফকির নইহির শা’র সঙ্গে। আলাপ করালেন লালন গীতি-র তত্ত্বজ্ঞানী হৃদয় শা-এর সাথেও.
কথায় কথায় খুললো নতুন ভাবনাবিশ্ব (paradigm?)। বাউল ফকির নির্যাতন, রোহিঙ্গা, সীমান্ত পেরোনো সন্ত্রাস কেন্দ্রিক সব আলোচনা যখন মাথা খুঁড়ছে তখন রাষ্ট্রের আধুনিক ভূগোল-কেই non-question করে দিয়ে বাউল ফকিরদের প্রশ্ন - কিসের অনুপ্রবেশ,কার সীমান্ত? নদীয়ার ফকির কুষ্টিয়ায় 'গুরু-বাড়ী' যাবেন,কে ঠেকায় তাকে? আধুনিক রাষ্ট্র! রাস্তা কেটেছে দেশভাগ আর রাষ্ট্রের বাহিনী হয়েছে মোতায়েন, বি এস এফ আর বি জি বি। এই ক'টা বছর আগেও সীমান্ত পেরিয়ে অনায়াস ছিলো যাতায়াত, বছরে দুটো তিথিতে সাঁইজির মাজারে,এসেছেন থেকেছেন, ফিরে গেছেন , নেইকো সেদিন আর। রাষ্ট্র তার সীমানা-কাঁটাতার, অভিবাসন আইন আর নিয়ন্ত্রণ এসবে ঘোর অবিশ্বাস তাদের, কোন ক্ষমতা কাঠামোর প্রয়োজনে এসব,তাদের প্রশ্ন। আর 'অনুপ্রবেশ'(!) যখন সাংস্কৃতিক? সাধকের নির্জন একাকী জীবনে?
কেন লালন সাঁই এর জাত কুল পদবী পরিচয় খোঁজার এত হিড়িক আজ?সাধু -সঙ্গ,তত্ত্ব আলাপ,পালাগান কেন কালে কালে গৌণ হয়ে পড়েছে সাঁই এর মাজারে মেলা কমিটির এই business venture-এ? কেন কমিটির নির্বাচনে দাঁড়াতে লক্ষাধিক টাকা আমানত রাখতে হয় প্রার্থীকে, কোন ফকিরের সাধ্য তা দেওয়া? কারা সুযোগ পায় মূল মঞ্চে গান গাইবার, বক্তৃতা করবার, সে নির্বাচনের পদ্ধতি কী?
কালী গঙ্গা মজেছে আজ....রাত কতো হলো,উত্তর মিলেনা।
"This Man of The Heart is ever and anon lost in the turmoil of things. Whilst he is revealed within, no worldly pleasures can give satisfaction. Their sole anxiety is the finding of this Man."
বন্ধু কেশব, পথে আসার পথে সেদিন গেদে লোকালে বসে মোবাইলের ডাউনলোডে পড়ে নিচ্ছিলো ১৯৩০ সালের হিবার্ট লেকচার,টেগোর দিয়ে লালন জানা ওর কাজে এলো কি? প্রথম বার এসেছে 'লালনে', নতুন হাতে পাওয়া দোতারা'টিতে সুর বাঁধতে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় চারপাশে, আর এই যে এত মানুষ, তিনদিনের মেলায় আসেন, রাতভর গান শোনেন, মেলা ঘুরে গেরস্থালির আর ঘরের লোকের মনিহারি সওদা করেন টুকিটাকি, ছোট্ট একতারা খানি তুলে দেন সঙ্গের কচি'টির হাতে, র্যা ব (বাংলাদেশ পুলিশ)-এর রক্তচক্ষু এড়িয়ে আবডালে অশীতিপর দরিদ্র ফকিরের হাতের ছিলিম ও দু'এক টান ঘোরান প্রসাদ জ্ঞানে, কি পান তারা? সাধু সঙ্গ প্রত্যাশী সহজ লোকজীবন কি মিথ্যা হয় তবে? খানিক চুপ থেকে উঠে পড়ি, ফিরতে হবে এবার আমাদের।
কে আবার রাতজাগা গলায় গান ধরে নেয়... “এসব দেখি কানার হাট-বাজার/এক কানা কয় আরেক কানারে/ চল এবার ভব-পারে/নিজেই কানা পথ চেনে না/পরকে ডাকে বারংবার”
তির্যকতায় সবাই ভিতর পানে চাই, লালন সাঁই এর গান কাকে না বেঁধে!
"আমরা, এক সচেতন প্রয়াস" ফিরে আসবে বারবার, দুইবাংলায় বাউল ফকির ধর্মাশ্রয়ী প্রান্তিক মানুষের উপর আজও চলেছে অত্যাচার। মেলায় অত্যাচারের তথ্যায়ন করা যায় না। একান্তে কথা বলা মুশকিল হয়, যা আমরা আগের বারেও টের পেয়েছি। আমাদের পৌছতে হবে আখড়ায়। আমাদের কাজ চলছে ।

No comments:

Post a Comment